বুধবার, ১৮ই জুন ২০২৫, ৪ঠা আষাঢ় ১৪৩২ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল nagorikdesk@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • বন্দিশালা থেকে ফিরলেন ১৫৮ বাংলাদেশি
  • অধ্যাদেশ বাতিল না হলে বৃহস্পতিবারও সচিবালয়ে বিক্ষোভের ডাক
  • এপ্রিলের পরিবর্তে ফেব্রুয়ারিতে হতে পারে নির্বাচন
  • এসএসএফ-কে দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করে যেতে হবে
  • বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য মানবতার সেবা করা
  • প্রতারণা করে জুলাই অভ্যুত্থানের সুবিধা নিলে ২ বছরের কারাদণ্ড
  • সচিবালয়ে আজও কর্মচারীদের বিক্ষোভ
  • ঢাকার বাতাসের মান আজ ‘সহনীয়’
  • তেহরানের ৪০০ বাংলাদেশিকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হবে
  • বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নেই, নেতারা অনলাইনে হম্বিতম্বি করছে

প্রতীক্ষায় আছি ”শিশুশ্রম” বন্ধ হবে একদিন!

মো: তানজিমুল ইসলাম

প্রকাশিত:
১৮ জুন ২০২৫, ১৬:৫৬

স্বাধীনতার এই সূবর্ণ জয়ন্তীতে এসে সার্বিক উন্নয়নের চিত্রটি দেখে মনটা জুড়িয়ে যায়। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজ আমরা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতিতে অনেকাংশেই এগিয়ে গ্যাছি বৈকি! আন্তর্জাতিক পর‌্যায়ে বাংলাদেশ আজ নানাভাবেই সু-পরিচিত! সব মিলিয়ে, একজন বাংলাদেশী হিসেবে নিশ্চয়ই আমরা গর্বিত! কিন্তু পুরো দেশের প্রায় ১৮ কোটি জনতার আর্থ-সামাজিক ও মানবাধিকারের কথা ভাবলে কি সত্যিই আমরা গর্বিত হতে পারি?

করোনার এই ভয়াল থাবায় পুরো দেশ যখন লকডাউনে নিমজ্জিত তখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশু সন্তানেরা কেমন ছিল? কোথায় ছিল? প্রায় একটি বছরের বেশি সময় ধরে যেখানে স্কুলের সাথে তাঁদের যোগাযোগ ছিলনা, ছোট্ট বাড়িতে বা বস্তি এলাকায় কেমন কাটতে পারে তাঁদের দৈনন্দিন? পরবর্তীতে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে বর্তমানেই বা কেমন আছে এদেশের কোমলমতি শিশুরা? ইতোমধ্যে মা-বাবার প্রাত্যহিক কাজের সহযোগী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করলেও, দ্রব্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিতে ও সংসারের সচ্ছলতা আনতে আজ তাঁরা নতুন করে উপার্জনকারী ‘শ্রমিক’ হিসেবে প্রমান করছে। আজকাল নতুন করে গৃহকর্মে, ইটের ভাটায়, কলকারখানায়, হোটেলে,ভ্যানে, এমনকি মাদক-জুয়ার আসরেও তাঁদের শ্রম বিক্রি হচ্ছে হরহামেশাই!

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ২০১৩-এর সংশোধন অনুসারে কর্মরত শিশু বলতে বোঝায়, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টা পর্যন্ত হালকা পরিশ্রম বা ঝুঁকিহীন কাজ করে। এ শ্রম অনুমোদনযোগ্য। অথচ, আইনের এই বিষয়টিকে তোয়াক্কা না করে শিশুশ্রম চলছে দেশের আনাচে কানাচে সর্বত্রই! যা শিশু সুরক্ষা তথা শিশু অধিকারের পরিপন্থি! আমরা যখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার আনন্দে পুলকিত; ঠিক সেই মুহুর্তে এই শিশু তথা আগামীর ভবিষ্যতের ভয়াবহতার কথা ভাবলে কি আর ভালো থাকা যায়?

শৈশবে যার হাতে থাকার কথা ছিল বই আর পেন্সিল, যাদের হাত ধরে এদেশ নতুন করে এগিয়ে যাবার কথা, তাঁরাই যেন আজ জীবিকায়নের মূল কারিগর হয়ে অভাবগ্রস্ত সংসারের সংগ্রামী সৈনিক সেজেছে! এক শ্রেণীর লোভী স্বার্থ পিপাসু মানুষ নামের দানবেরা এই সকল শিশু ও তাঁর পরিবারের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে নামমাত্র পারিশ্রমিকে তাঁদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে। কেননা, শুধুমাত্র বয়সে কম অথবা শিশু হবার জন্যই তাঁদের শ্রমের মূল্য খুবই নগন্য হয় এ সমাজে!

সারা পৃথিবী জুড়েই শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করতে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যপক কর্মসূচি গৃহীত হলেও শিশু নির‌্যাতন তথা শিশু অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি থেমে নেই একটি মুহুর্তের জন্যেও! চোখের সামনেই এমন অজস্র ঘটনার সাক্ষী আমরা সবাই! নির্বাক দর্শক-শ্রোতা হয়ে কেবল হজম করে ফেলি সবকিছুই! আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিশু অধিকার সনদে মূলনীতি হিসেবে (১)বৈষম্যহীনতা,(২)শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা, (৩)শিশুর অধিকার সমুন্নত রাখতে অভিভাবকদের দায়িত্ব ও (৪)‘শিশুদের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন’ এর কথা উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশের মতো এই বৈচিত্রময় দেশটিতে বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে এর যথাযথ প্রয়োগ খুবই বিরল! মজার ব্যাপার হলো, একই ছাদের নীচে বাড়িওয়ালার শিশু-সন্তানেরা যখন ঘুমকাতুরে হয়ে সকাল ১০টায় বিছানা ছেড়ে ওঠে, একই বয়সী গৃহকর্মী নামক আরেকটি শিশুকে তখন কাকভোরে উঠে রুটিন মাফিক ভারী কাজে মনোনিবেশ করতে হয়! নিয়মিত কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হলেও কোনদিন কোনো বাড়তি প্রশংসা না জুটে না। অথচ, একদিন ব্যাতিক্রমী কিছু ঘটলেই পুরষ্কার হিসেবে জুটে শারীরিক ও মানসিক নির‌্যাতন! আর এসবের সাক্ষী হয় তাঁদেরই সমবয়সী আলালের ঘরে দুলালেরা! তবে কি শিশু অধিকার সনদ কি কেবলই ঐ অভিজাত শ্রেনীর বিশেষ শিশুদের জন্যই?

শিশুশ্রম কেবল একটি শিশু বা তাঁর পরিবারকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে না বরং অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলে তাঁর সকল সম্ভাবনা! নিষ্পাপ শিশুর শৈশবকে যারা গলা টিপে হত্যা করে বা যারা প্ররোচিত ও বাধ্য করে তাঁরা আসলে কেমন মানুষ! মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি হলো সু-শিক্ষা (প্রাতিষ্ঠানিক ও বাস্তবভিত্তিক)। কিন্তু অনুকুল পরিবেশের অভাবে অন্য আরেকটি মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ অন্ন জোগাড় করতে তখন তাঁকে শৈশবেই যুবকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় এ দেশে! কাজ যতই হোক পারিশ্রমিকের বেলায় (অল্প টাকায়) কেবলমাত্র শৈশবকে বিবেচনা করা হয় এ সমাজে!

বাংলাদেশ সরকার ছাড়াও দেশী-বিদেশী উন্নয়ন সংস্থা সমূহ শিশুশ্রম রোধে নানাবিধ কাজ অব্যাহত রাখলেও শিশুশ্রম কমছে না কিছুতেই! ক্রমশ: শিশুশ্রম বন্ধের লড়াইয়ে আমরা যেন হারতে বসেছি। নতুন করে করোনাভাইরাস মহামারী আমাদের অনেক পেছনে ঠেলে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশে ৩২ লক্ষ শিশু শ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে ১৩ লক্ষ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত যা তাঁদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও নৈতিকতার জন্য ক্ষতিকারক। সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো বাংলাদেশেও শিশুশ্রম নিরসন দিবস পালিত হলেও আদৌ কি শিশুশ্রম কমছে এতটুকু? এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো: "অগ্রগতি স্পষ্ট, কিন্তু আরও কাজ করার আছে: আসুন প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করি!" তাই সরকারি বেসরকারি ও সামাজিক প্রতষ্ঠানসমূহকে একযোগে সমন্বিত উদ্যাগ নিতে হবে খুব জোরেসোরে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৮.৭-এ বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করার কথা থাকলেও বাস্তবে তার ভিন্ন চিত্র! আর তাই শিশুশ্রমরোধে কাজ করার এক্ষুণি তাঁর প্রকৃত সময়! সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ কোভিড-১৯ মহামারির কারণে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এর ফলে শিশুশ্রমের ওপর কী প্রভাব পড়ল, তার হিসাব কেউ রাখছে কি? এক বছরের অধিক সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুশ্রম কতটা বেড়ে গেল, তা কি আমরা জানি? হয়তো জানি! হয়তো স্বীকার করিনা!

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রম নিয়োগ সম্পর্কে যে-মান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেখানে মূলত চারটি মাত্রার কথা বলে হয়েছে: সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, যৌথ দর-কষাকষির অধিকার, শিশুশ্রমিকের অনস্তিত্ব ও বৈষম্যহীন নিয়োগ ব্যবস্থা। এগুলি নিশ্চয়ই সব দেশে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে এর প্রয়োগকৌশল নিয়ে। দিন, মাস, বছর যায়! সময়ের পরিক্রমায় শিশু দিবস, শিশু অধিকার সপ্তাহ, শিশুশ্রম দিবস, মানবাধিকার দিবস পালিত হয়। অনেকে আবার শিশুদের উন্নয়নে অনেক কাজ করে, গবেষণা চালিয়ে যায়! বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়! অনেকে আবার দেশ বরেন্য মানুষের স্বীকৃতি পায়! আনেক নামী-দামী পুরষ্কারও পায়! কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্যি আমজনতার শিশুদের অধিকার কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয় না! বন্ধ হয় না শিশুশ্রম!

শিশুশ্রম ও শিশু অধিকারের বিষয়টি আমাদের মনে নিশ্চয়ই অনেক বেশি নাড়া দেয়! সত্যিই তাই! বাস্তবতা হলো: সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করতে না পারলে শিশুশ্রম কমবে না, শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না। এক্ষেত্রে রাস্ট্রের ব্যপক ভুমিকা রয়েছে। সুন্দর আগামী’র জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা যেমন জরুরী, ঠিক তেমনি প্রয়োজন, প্রতিটি শিশুর জন্য আমজনতার আন্তরিক ভালোবাসা! নয়তো, এই শিশুরাই আগামীতে গর্বিত নাগরিক না হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি সহ নানান অপকর্মে জড়িয়ে যাবে! রাগ-ক্ষোভ-অভিমানে এদেশের মানচিত্রকেও হয়তো তাঁরা চিবিয়ে খেতে চা’বে একদিন!

যদিও বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী এদেশে ‘বাড়ছে শিশুশ্রম, বঞ্চিত হচ্ছে শিশু অধিকার’! তবুও যে কোনও সচেতন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিই চাইবেন শিশুশ্রম বন্ধ হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক শিশু অধিকার!আমরাও প্রত্যাশায় আছি সেদিনের! হয়তো সেদিন সন্নিকটে!

লেখক:
মো: তানজিমুল ইসলাম
কো-অর্ডিনেটর, এডভোকেসি এন্ড সোশ্যাল একাউন্টিবিলিটি
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ।
০১৭৬৭-৫৯১৩৫৬


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর